Date: 02-12-2024, 06:49 pm
Author: আব্দুর রহিম বিন আব্দুর রাজ্জাক
জীবন গঠনে এক অপরিহার্য গুণ
অতি দুঃখজনক যে আমরা ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত এই الأمانة বা আমানত শব্দটিকে সংকীর্ণ করে ফেলেছি। আমানত বলতে শুধুমাত্র আর্থিক আমানতদারীতাকেই বুঝে থাকি। মূলত আমাদের জীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত, উপভোগ্য ও পরকালকে কল্যাণময় করতে আমানতদারীতার ভুমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমানতের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য :
আমানতের ধরন:
কুরআনে আমানতের গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমানতদারিতা
রাসূল (সা.)-এর চরিত্রের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর আমানতদারিতা। নবুয়তের পূর্বেও তিনি "আল-আমিন" (বিশ্বাসযোগ্য) নামে পরিচিত ছিলেন। কুরাইশরা তাঁর প্রতি এতটাই আস্থাশীল ছিল যে, তাঁর হত্যা পরিকল্পনা করার সময়ও নিজেদের আমানত তাঁর কাছেই রেখে দিয়েছিল। হিজরতের সময় রাসূল (সা.) তাঁর কাছে রাখা মুশরিকদের গচ্ছিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার জন্য আলী (রা.)-কে নির্দেশ দেন।
শুধু মুহাম্মদ (সা) নয় বরং সকল নবীই এই মহান বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। যেমন সূরা শুয়ারা এর 107 নাম্বার আয়াতে মুসা আলাইহিস সালাম তার সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বলেন :
إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ অর্থাঠ নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসুল।
একই কথা হুদ (আ) ১২৫ নাম্বার আয়াতে, সালেহ (আ) ১৪৩ নাম্বার আয়াতে, লুত (আ) 162 ও শোয়াইব (আ) 178 নাম্বার আয়াতে বলেছেন। সুবাহানাল্লাহ।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে আমানত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্য বহনকারী একটি অমূল্যবান সিফাত, অথচ আমরা এই সিফাতকে বলতে আমরা শুধুমাত্র বুঝি টাকা পয়সার আমানত। এমনকি কোন প্রকার শরীয়ত বিরোধী কাজ করি তাহলে তার নাম খেয়ানত।
কোন কোন বিষয় আমানত অন্তর্ভুক্ত:
১. ঈমান ও ধর্মীয় দায়িত্ব: "এটা আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতকে আমানত হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা নিতে অস্বীকার করেছিল। তবে মানুষ তা গ্রহণ করেছে।" (সূরা আহজাব: ৭২)
২. ব্যক্তিগত আমানত: "আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন যে, তোমরা আমানত তাদের প্রকৃত মালিকদের কাছে পৌঁছে দেবে।" (সূরা নিসা: ৫৮)
৩. সম্পদ ও ধনসম্পত্তি: "তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।" (সূরা বাকারা: ১৮৮)
৪. নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব: "হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি।" (সূরা সাদ: ২৬)
৫. সাক্ষ্য ও সত্য কথা বলা: "তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না।" (সূরা বাকারা: ২৮৩)
৬. সন্তানদের লালন-পালন: "তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।" (সূরা তাহরিম: ৬)
৭. বিবাহ ও পারিবারিক জীবন: "তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করো।" (সূরা নিসা: ১৯)
৮. দেহ, মন ও সময়: "তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেও না।" (সূরা বাকারা: ১৯৫)
৯. সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব: "আত্মীয়দের প্রতি তাদের অধিকার দাও।" (সূরা ইসরা: ২৬)
১০. জ্ঞান ও বিদ্যা: "তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, তারা জানে যে এটি (কুরআন) তোমার প্রভুর কাছ থেকে প্রাপ্ত সত্য।" (সূরা বাকারা: ২৬৯)
আমানত যেভাবে রক্ষা হবে:
১. আমানত প্রদান কারীর নিকটে পৌঁছে দেয়ার আগ পর্যন্ত হেফাজত করা।
২. সময়মতো হকদারকে আমানত পৌঁছে দেয়া।
৩. মানুষের গোপনীয়তা রক্ষা করে
৪. যে খেয়ানত করবে তার সাথে কোনকিছু শেয়ার না করা
আমানত হারিয়ে যাওয়ার কারণ:
১. ইমানের দুর্বলতা: আল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাবদিহিতার অভাব আমানতের প্রতি গাফিলতি সৃষ্টি করে। (সূরা আনফাল: ২৭)
২. লোভ ও স্বার্থপরতা: ব্যক্তিগত লাভের জন্য আমানত রক্ষা না করা হয়।
৩. জ্ঞান ও শিক্ষার অভাব: ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে আমানতের গুরুত্ব না বোঝা।
৪. নৈতিকতার অবক্ষয়: সমাজে নীতি-নৈতিকতার অভাব হলে আমানত রক্ষা না করা হয়। (বুখারি: ৫৯)
৫. পারিবারিক অবহেলা: সঠিক শিক্ষা না দিলে ব্যক্তির মধ্যে আমানত রক্ষার মনোভাব সৃষ্টি হয় না।
৬. কঠোর আইন ও দণ্ডবিধির অভাব: কঠোর আইন না থাকলে আমানত নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
৭. বিশ্বাসের অভাব: সমাজে পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে আমানত রক্ষা করা কঠিন হয়।
৮. চরিত্রের দুর্বলতা: মিথ্যা ও প্রতারণার স্বভাব আমানত হারানোর প্রধান কারণ।
এছাড়া, ইলম এবং ন্যায়পরায়ণতা ছাড়া আমানত রক্ষা সম্ভব নয়। ইলমের অভাবে জাহালত এবং ন্যায়পরায়ণতার অভাবে জুলুম সৃষ্টি হয়, যা আমানত নষ্ট করতে সাহায্য করে।
আমানতদারিতা উঠে যাওয়ার কুফল:
আমানতদারিতা হারালে সমাজে নানা কুফল সৃষ্টি হয়:
1. বিশ্বাসের অভাব: পারস্পরিক আস্থা ভেঙে যায়, যার ফলে সম্পর্ক দুর্বল হয়।
2. সামাজিক বিশৃঙ্খলা: প্রতারণা, চুরি ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, যা শান্তি বিঘ্নিত করে।
3. নৈতিক অবক্ষয়: নৈতিক মূল্যবোধ লোপ পায়, মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পায়।
4. দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতি: দুনিয়ায় লজ্জা, আখিরাতে কঠিন শাস্তি।
5. নেতৃত্বের অপব্যবহার: ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি করে, বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
6. অর্থনৈতিক দুর্নীতি: ব্যবসায়িক প্রতারণা, জালিয়াতি ও চুক্তি ভঙ্গের ঘটনা ঘটে।
7. পরিবারে অশান্তি: পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, শান্তি বিঘ্নিত হয়।
8. আল্লাহর অপছন্দ: আমানত রক্ষা না করলে আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় হয়ে পড়ে।
এগুলো প্রমাণ করে, আমানতদারিতা রক্ষা না করলে ব্যক্তি ও সমাজে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
আমানত শুধুমাত্র মালিকের সম্পদ নয়, এটি বিশ্বাস ও দায়িত্বের প্রতীক। কুরআন ও হাদিসে আমানত রক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যখন আমরা আমানত রক্ষা করি, আমরা আল্লাহর নির্দেশ পালন করি এবং সমাজে সততা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করি। তাই আমানত রক্ষা করা মুসলমানদের জন্য একটি মৌলিক দায়িত্ব এবং এটি আমাদের চরিত্রের উন্নতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
write_a_public_review